Wednesday, June 13, 2018

১৫ই আগষ্টের পরে পঁচাত্তরের ৩ ও ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ

১৫ই আগষ্টের পরে পঁচাত্তরের ৩ ও ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ওপর যে অভিঘাত নেমে আসে সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, যে উদ্দেশ্যে করেছিল, তারাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথকে পরিষ্কার করার জন্য ৩ নভেম্বর জেলখানার ভেতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। আরেকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মাঝখানে মাত্র চার দিন পিছু হটে থাকার পর পুনরায় ৭ নভেম্বর তথাকথিত বিপ্লবের নামে ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর যে অভিঘাত নেমে আসে তা থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। আজকে বাংলাদেশে যে চরম রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা, ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং লুটপাটের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অব্যাহত আছে তার মূলে রয়েছে ১৫ আগস্ট এবং তার ধারাবাহিকতায় ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত। ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর অনেক কিছুই এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। ঘটনাগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িতদের মধ্যে অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা হয়তো মুখ খুলছেন না। সব সুযোগ ও শক্তি থাকার পরও কেন ৩ নভেম্বর চালিত খালেদ মোশারফের অভিযান ব্যর্থ হলো? কেন জেলখানায় অবস্থিত জাতীয় চার নেতার জীবন রক্ষা করা সম্ভব হলো না? ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থান ছিল সম্পূর্ণ রক্তপাতহীন, একটি মানুষের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়নি, অথচ জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে পরিস্থিতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এবং বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে কেন ৭ নভেম্বর সকালে নাশতারত অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করল? কার সম্মতিতে বা কার হুকুমে মহান মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সেনানিদের হত্যা করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে কেউ হয়তো বলতে পারেন, সময়ের উত্তেজনাবশত এসব ঘটনা ঘটে গেছে। এ রকম যারা ভাবেন তারা কেন ভাবেন না যে, খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত ক্ষণস্থায়ী অভ্যুত্থান ছিল আরও ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ, কিন্তু কই, ওই চার দিনে তো একজন মানুষকেও জীবন দিতে হয়নি। জাতিকে অগ্রায়ণের পথে রাখার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর ও তার সমাধান প্রয়োজন।
সত্য একদিন বেরোবেই, তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিন পর্যন্ত আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। তাই প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই এখন দেখা যাক ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার নেতার হত্যার পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন করা হয়। জেনারেল খালেদ মোশারফ ও কর্নেল জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর ভোর হতে হতেই রক্তপাতহীন ও নীরব অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়ে যায়। ১৫ আগস্টের পর বঙ্গভবনে জেঁকে বসা খুনি মেজররা সারা দিন দর কষাকষি শেষে ওই দিন সন্ধ্যার পর দেশত্যাগ করে চলে যায়। এ সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার প্রথম ধাপেই ২ নভেম্বর রাতে, ৩ নভেম্বরের প্রত্যুষে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, অত্যন্ত নৃশংস ও বর্বরতার সঙ্গে। বঙ্গভবন থেকে প্রথমে মেজর রশিদ এবং দ্বিতীয়বার দেশের স্বয়ং রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এ হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেন, যার বিস্তারিত বিবরণ এন্থনি মাসকারেনহ্যাসের- ‘এ লেগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থের ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে। ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসালদার মোসলেমউদ্দিন সেনানিবাস থেকে ঘাতকদল নিয়ে জেলখানায় হাজির হয়। খুনি মেজররা তখন ছিল বঙ্গভবনে।
এতে বোঝা যায় জেলহত্যা ছিল ১৫ আগস্টের খুনিদের পূর্ব পরিকল্পিত কন্টিজেন্সি প্ল্যান। অর্থাৎ ১৫ আগস্টের উদ্দেশ্য সামান্যতম হুমকির সম্মুখীন হলে চার নেতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে, যাতে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো আর কেউ বেঁচে না থাকে। পরিস্থিতির বিশ্লেষণে মনে হয়, ১৫ আগস্টে চার নেতাকে অন্যদের সঙ্গে হত্যা না করে মোশতাক একটা সুযোগ নেওয়ার পথ খোলা রেখেছিলেন, যদি ওই চার নেতাকে দলে ভিড়ানো যায় তাহলে সেটা হতো মোশতাকের জন্য সোনায় সোহাগা। কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টায় তা সম্ভব না হওয়ায় তাদের জেলে ঢোকানো হয়, যাতে সময় সুযোগমতো খুনিরা যে কোনো বিকল্প প্ল্যান কার্যকর করতে পারে। বিভিন্ন সোর্স থেকে ওই সময়ের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার প্রায় দুই/তিন ঘণ্টা পর জেলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনাকে বিদায় করে পাকিস্তানের চেতনা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। তাজউদ্দীন ছিলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আপসহীনভাবে এগিয়ে নিতে পারতেন। শত্রুরা সেটি ঠিকই বুঝেছিল, তাই দেখা যায় তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সরকারে তখন ছিলেন না, বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদেও ছিলেন না, তবুও তাকে অন্য তিন নেতার সঙ্গে হত্যা করা হলো। এতেই বোঝা যায়, শত্রুদের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কি ছিল। এ বিষয়ে জেলহত্যা মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়-
‘The conspirators for whom the killers committed this criminal act made their plan so that everything the people of this country fought for and dreamt about would be destroyed’. ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের মধ্যে অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় (এ লেগেসি অব ব্লাড-এন্থনি মাসকারেনহ্যাস, পৃ : ৭৭)। সুতরাং ১৫ আগস্টের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে যে আরেকটি পাকিস্তান স্টাইলের রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল তা কিন্তু খুনিরা একেবারে প্রথমেই ঘোষণা দিয়ে দেয়। আরেকজন বাঙালি, নাম মাহমুদ আলী, বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি একাত্তর সালে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ইউরোপ-আমেরিকা সফর করেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানে পালিয়ে যান। 
এহেন মাহমুদ আলী পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর দূত হিসেবে ১৫ আগস্টের পরপরই বিশেষ মিশন নিয়ে লন্ডনে হাজির হন এবং বাংলাদেশের খুনি ও সদ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক-বেসামরিক অধিকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এন্থনি মাসকারেনহ্যাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদ আলী বলেন,“I want reunification of Pakistan, This Bangladesh thing must be finished with” (প্রাগুক্ত- পৃঃ ৮৬)। এই মাহমুদ আলীরা বাঙালি হয়ে বাঙালিদের স্বার্থ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং কী রকম ভয়ানক অকৃতজ্ঞ হতে পারেন তার একটি উদাহরণ দিই। মাহমুদ আলী তো পালিয়ে গেলেন ১৬ ডিসেম্বরের আগে, কিন্তু এ দেশে রয়ে গেল তার স্ত্রী ও মেয়ে। এই মেয়ে রত্নটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে অশালীন ভাষায় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা জনতার হাতে তারা লাঞ্ছিত হবেন অথবা কন্যা রত্নটি কোলাবরেটর আইনে জেলে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে কিছুই হতে দিলেন না। পুলিশকে আদেশ দিলেন মাহমুদ আলীর পরিবারের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার। ২০ হাজার টাকা ও পাসপোর্ট দিলেন এবং তাদের গোপনে দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার প্রবল শত্রুর পরিবার-পরিজনের ওপরও কখনো প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেননি (ইতিহাসের রক্তপলাশ- আ. গাফফার চৌ. পৃঃ ৮১)। এহেন মাহমুদ আলী ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে ‘মীরজাফর’ আখ্যা দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর অভিযানে নেমেছিলেন। কিন্তু মাহমুদ আলীরা পরিপূর্ণ সফল হতে পারেনি। তার মূল কারণ ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বাংলাদেশের মাটিতে মিশে আছে। তাই বাংলার এই মাটির একটা প্রবল সহজাত শক্তি আছে। সেই শক্তির প্রত্যাঘাতে মাহমুদ আলীরা কিছুটা পিছু হটার কারণেই আজ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ফাঁসি হচ্ছে।
এবার কিন্তু একটা কাকতালীয় বিষয়ও ঘটে গেছে। জেলহত্যা দিবসে এ বছর ৩ নভেম্বরে একাত্তরের গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট। অদৃশ্যের লীলা কাকে বলে! ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাতের উদাহরণ কত দেব। লিখে শেষ করা যাবে না, আবার অনেক কিছুর পুনরাবৃত্তি হয়ে যেতে পারে। তবুও আমি মনে করি, নতুন প্রজন্মের জন্য, এ দেশের মানুষের জন্য বারবার আমাদের লিখতে হবে, যতদিন না ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হচ্ছে। এই যে যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লা এবং গণহত্যাকারী কামারুজ্জামান- এরা দুজনই জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। অথচ প্রেসক্লাব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম একটি সূতিকাগার। এখন ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লব সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলে লেখার উপসংহারে চলে যাব। ক্যু ও বিপ্লবের মধ্যে যে পার্থক্য পণ্ডিতেরা করে গেছেন প্রথমেই তার একটু উল্লেখ করতে চাই। A coup is a single act and a revolution is a continuous movement. A coup is an occurrence, a revolution is an era. A coup brings about a change in personnel, a revolution brings about basic change in the structure of the society. In the revolution key role is played by the people, in a coup it is only few military personnel are involved (Elizer Beeri)। কিউবা, রাশিয়া, চীন ও অধুনা ইরানসহ প্রতিটি বিপ্লবের ক্ষেত্রেই একজন বিপ্লবী নেতার নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে।
চূড়ান্ত বিজয়ের আগে বিপ্লবী নেতাদের দেশের বৃহত্তর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নেতা কে ছিলেন? বিপ্লবের জন্য আবশ্যকীয় সেই সংগঠন কোথায় ছিল এবং তাদের সংগ্রামেরই বা স্বরূপ কেমন? যারা ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করেন তারা অতি ধূর্ততার সঙ্গে এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলেন। বিপ্লব থাকে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল। সেখানে বিপ্লবী দলের কোনো ব্যক্তি বা সৈনিক লক্ষ্যহীন ও শৃঙ্খলচ্যুতের কাজ করলে নিজের কমরেডদের হাতে পেতে হয় চরম শাস্তি। ৭ নভেম্বরের পরের দিন ৮ নভেম্বর উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা ২৪ জন নিরীহ অফিসারকে হত্যা করল। এর দায় কার ওপর বর্তাবে? নিরীহ অফিসারদের যারা হত্যা করল, কই তাদের বিচার তো ওই বিপ্লবের তথাকথিত নেতারা কেউ করলেন না। আর সংহতির কথা বললে তো বলতে হয় সংহতি হওয়ার কথা ছিল জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহেরের মধ্যে। কারণ ৭ নভেম্বরের উদ্যোক্তা ছিলেন কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন জাসদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু কর্নেল তাহেরের অস্থিরতা এবং জিয়াকে বুঝতে ভুল করায় উল্টো ঘটনা ঘটে যায়। ৭ নভেম্বর সকালে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের সাক্ষাৎ হওয়ার আগে একাত্তরের পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির কব্জায় চলে যায় জিয়াউর রহমান। ওই ঘোলাটে অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অতি মূল্যবান। কর্নেল তাহেরের সেই ভুলের জন্য মাত্র সাড়ে আট মাসের মাথায় একটি প্রহসনের বিচারে তাকে প্রাণ দিতে হয়। শুধু ঢাকা শহরের রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও সেনাবাহিনীর কয়েকটি লরির ওপর পাকিস্তানের আইএসআই কর্তৃক প্ররোচিত কিছু লোকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেওয়াকে আর যাই হোক বিপ্লব বলা যায় না। প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বলতে যা বোঝায়, ৭ নভেম্বর যদি সেটাই হতো তাহলে সারা দেশের জনগণের সেই বিপ্লবে অংশগ্রহণ থাকত। তাদের স্লোগান হতো জনকল্যাণের স্লোগান, তা হতো নির্যাতিত মানুষের মুক্তির স্লোগান এবং হতো বিপ্লবের প্রকৃত আদর্শের ধারাতে। সেখানে একাত্তরের বিতাড়িত জিন্দাবাদ স্লোগান ওঠত না। বিপ্লবের একটি আদর্শ ও দর্শন থাকে, যার দিকে মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য বিপ্লবী সংগঠন ও নেতাদের কঠিন ও দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। নেতাদের ত্যাগের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভেতর আস্থা সৃষ্টি করতে হয়। মানুষ তখন শুধু আদর্শের জন্য, ব্যক্তিগত কিছু পাওয়ার জন্য নয়, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দল বেঁধে এগিয়ে আসে। সেই এগিয়ে আসা জনস্রোতকে কোনো শক্তিই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যার উদাহরণ আমরা দেখেছি রাশিয়া, চীন, কিউবা ও ইরানের বিপ্লবসহ ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর।
এক রাতের মধ্যে বা দু-এক সপ্তাহের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনার মাধ্যমে বিপ্লব হয় না। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কোনো বিপ্লব হয়নি, ওটা ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর চরম অভিঘাত। এই অভিঘাতের ফলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতসহ উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশে। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিলে সেই রাজনীতিক দলের কি অবস্থা হয় তা এখন বোঝা যাচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বেরোবার পর বিএনপির মতো এতবড় একটি দলকে মুখ বুঁজে থাকতে হচ্ছে, এদিক-ওদিক কোনো কিছুই বলতে পারছে না। ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে আজ বড় অন্তরায় হলো, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সুশীল সমাজসহ সর্বক্ষেত্রে ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাতের ফলে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণির শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা যদি সত্য হয়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে অভিঘাত মুক্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তার পরিপূর্ণ জয় একদিন হবেই।
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Sunday, June 10, 2018

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ৮ ও ৯নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এখলাছ উদ্দীন এবং জেষ্ঠ সন্তানের রক্তে রন্জিত হবে নবগঙ্গা...!


আজএগারোই জুন, বাবা ও বড় ভাইয়ের ৩৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। Image may contain: 1 person, textএখন রাত বারোটা, এ রাতে আমার ঘুম আসেনা। কিছুক্ষণ পরেই ঘটে যাবে আমার ও আমাদের পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক মর্মান্তিক দুঃর্ঘটনাটি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ৮ ও ৯নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এখলাছ উদ্দীন এবং জেষ্ঠ সন্তানের রক্তে রন্জিত হবে নবগঙ্গা...! যে শহীদদের চোখে দেখিনি শুধু মহান ত্যাগের গল্প কাহিনী পড়ে জানতে পেরেছি, তাদের প্রতি আমার ঠিক ৭৫ এর ১৫ই আগষ্টে ঘটে যাওয়া এবং ৩ রা নভে বদ্ধ জেলের প্রকোষ্ঠে নিহত জাতীয় ৪ নেতার প্রতি নিবিষ্ট সকল শ্রদ্ধা ও ভক্ত এবং সমবেদনা সমমানের। এক এক সময় ভাবী বোধ হয় ওরকম মৃত্যুর মাঝে এক অনন্ত আত্ম তৃপ্তি ছিল। এ নষ্ট ভ্রষ্ট নিকৃষ্ট হীন মন মানসিকতায় ভরিপুর সমাজ ও রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদরা তাদের সোনালী দিনের সূর্যকে ডুবিয়ে দেয়নি। এ অনিয়মতান্ত্রিক অব্যবস্থা দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির জন্য আমরা যুদ্ধে যাইনি। আর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু, জাতীয় ৪ নেতা এবং এখলাস উদ্দিন স্যারদের সারা জীবন জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করার মূল লক্ষকে সারাদিন মূখে জয় বাংলা বলে গগন ফাটালেও বক্ষে ধারন করিনি। আমরা আসলেই জাতীয় জননেতা মহান স্বাধীনতার সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ ৪০ হাজার মা বোনের সাথেই বেঈমানী করছি কিন্তু মূখে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মিথ্যে আস্ফালন করছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান করছি না বরং তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ঠিক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার নামে সব ভন্ডামী ও প্রতারনা করছি। স্বয়ং আওয়ামী লীগের ভিতরেই এখন সে ৭১ এর পাক হায়েনার বীজ এবং খন্দকার মোস্তাকের প্রেতাত্ত্বা ঘাপটি মেরে বসে আছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। না পারছি নৌকা আওয়ামী লীগ ছাড়তে না পারছি একান্তভাবে কষে ধরতে। আমরা কোথায় যাবো? 

*****************
এখলাছ উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিলেন, পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং সে যুদ্ধে জয়ী হয়ে বীরের বেশে দেশে ফিরে এসেছিলেন। সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করেছিলেন দেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করার জন্য। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। কিন্তু ততোদিনে বাংলার আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের অতন্দ্র প্রহরীরা দেখেছিলেন সে ঘন কালো মেঘ, কিন্তু তার ভয়াবহতা, বিভৎষ্যতা অনুধাবন করতে পারেননি । আমলে নেননি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে প্রতিবিপ্লবী শক্তির উত্থান। এই উদারতা বা ভুলের জন্য বঙ্গবন্ধু শুধু নিজের রক্ত দিয়ে নয়, পুরা পরিবারের এবং সারা জীবনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরদের রক্ত দিয়ে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।
Image may contain: 1 person
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তী বাবা আরো দশটি বছর বঙ্গবন্ধুর সেই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ধারণ করে বেচে ছিলেন। কিন্তু তার সে জীবনটা ছিলো কঠিন এক সংগ্রামী জীবন এবং তিনি সংগ্রাম করেছিলেন সেই স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত প্রতিবিপ্লবী অপশক্তির বিরুদ্ধে। আপোষ করেননি, তবে করতে পারতেন। আপোষ করলে এখলাছ উদ্দীনকে হয়তো এভাবে স্বপুত্র মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতোনা, বেচে থাকতেন এবং নিজ পুত্রের লাশ কোলে নিয়ে মৃত্যুর জন্য নবগঙ্গার বালু তীরে অপেক্ষা করতে হতোনা।
না, এখলাছ উদ্দিন রাজনীতি ছাড়েননি এবং আপোষ বা মোস্তাকের আবরণও পরেননি। টিমটিম করে জ্বলা রাজনীতির সে মশালটি তিনি বহন করেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পনেরো দলের প্রায় প্রতিটি জনসভায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বর্ননা করতেন। মানুষও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন তার সেই বক্তব্য এবং জানার ও বুঝার চেষ্টা করতেন সেই অজানা আদর্শকে। অথচ এখলাছ উদ্দীন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালের দায়িত্বশীল কোনও পদে ছিলেন না, তিনি ছিলেন পদাধিকার বলে(সংসদ সদস্য) বাকশালের একজন সাধারণ সদস্য। বঙ্গবন্ধু জানতেন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি, তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কতটা বিপদজনক। আমলে নেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর এখলাছ উদ্দীনও জানতেন সে বিপদের কথা। কিন্তু তিনিও আমলে নেননি। বঙ্গবন্ধুর সে রাজনীতির মশালটি নিয়ে সামনে এগিয়েছেন। তিনি জানতেন স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত প্রতিবিপ্লবী শক্তি তাকে হত্যা করবে। পিছু হটেননি, জ্বালিয়ে রেখেছিলেন টিমটিম করে জ্বলা রাজনীতির সে মশালটি।
আওয়ামী রাজনীতির সে মশালটি বার বার জ্বলে উঠেছে। একানব্বই সালে
ষড়যন্ত্রকারী প্রতিবিপ্লবী শক্তি আবারও আওয়ামী রাজনীতিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ছিয়ানব্বই সালে রাজনীতির সে মশালটি দাবানলের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের ধংস করে দেয়। ফিরে আসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, এবং প্রাণ ফিরে পায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার প্রক্রিয়া এবং সেটা ছিলো এক অসাধ্য সাধন। বিচারহীন সমাজকে আইনের আওতায় আনা কঠিন বাস্তবতা। আবারও ফিরে আসে পঁচাত্তর দুইহাজার এক সালে এবং শুরু হয় আওয়ামী লীগকে ও তার রাজনীতিকে ধংস করার প্রক্রিয়া। কিন্তু ততোদিনে আওয়ামী লীগের শরীরের তৈরী হয়ে গেছে এন্টিবডি। তাকে ধংস করা যায়নি। আওয়ামী রাজনীতির সে মশালটি দাওদাও করে আবারও জ্বলে উঠে। সে আগুনে স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিবিপ্লবী রাজাকারদের ঝুলতে হয় ফাসীর কাষ্ঠে, আর এখন ধংসের দ্বারপ্রান্তে।


তবে ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। বর্তমান রাজনীতি বুঝতে হলে আমাদেরকে ফিরে তাকাতে হবে স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের তথা আআওয়ামী রাজনীতির দিকে। আওয়ামী লীগের আদর্শবাদী রাজনীতি তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে । ক্যান্সার জীবাণু শরীরের সুস্থ কোষগুলিকে নিজেই খেয়ে ফেলে এবং আওয়ামী লীগের দেহের তখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ক্যান্সার জীবাণু, বাংলার আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে, চারিদিকে দূর্যোগের ঘনঘটা। তার ভয়াবহ পরিনতি পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট এবং প্রতিবিপ্লবী স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ক্ষমতায় ফিরে আসা।
আওয়ামী লীগের নেতাদের আহ্বান জানানোর ধৃষ্টতা আমার নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো অনুরোধ করছি প্লিজ আপনারা রাজনীতি করুণ। রাজনীতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে নিজের শরীর তারা নিজেরা খেয়ে ফেলে। তবে এটা স্বাধীনতা পরবর্তী বা পঁচাত্তর পরবর্তী সময় নয় এবং এটা দুই হাজার আঠারো সাল। বিশাল ব্যবধান। যুগটি ডিজিটাল। রাজনীতিকে ক্যান্সার জীবাণু থেকে মুক্ত করা খুব সহজ, প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। বিজ্ঞান -প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষেধক প্রয়োগ করুণ এবং ধারণ করুন নুতন দর্শন, নুতন চেতনা যার থাকবে একটা সৌন্দর্য। যুগে যুগে আওয়ামী রাজনীতি সেটা ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগ তার জন্মলগ্ন থেকেই নুতন দর্শন, নুতন চেতনা নিয়ে জনগণের সামনে এসেছে, জনগণ তাকে বিমুখ করেনি এবং ভবিষ্যতেও বিমুখ করবেনা।
ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবা বড় ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়বেন...আপনজনেরা তখনও ঘুমিয়ে আছে, আর নবগঙ্গার বালুর চরে রক্তাক্ত সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর মুক্তযোদ্ধা আমার বাবা... আমরা শোকাহত .... তুমি রবে নিরবে হ্নদয়ে মমো !!!

Thursday, June 7, 2018

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস আজ

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস আজ 
ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস আজ। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী একটি দিন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। এ দিনটি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে স্পষ্টত নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে। আর এ ছয় দফার মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।Image may contain: 2 people, crowd and outdoor
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপন করেন এবং পরদিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ থেকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা উত্থাপন করেন। সেদিন পাকিস্তানের তত্কালীন সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফা মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ছয় দফার সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামীলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মাসব্যাপী ছয় দফা প্রচারে ব্যাপক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া পাকিস্তান স্বৈরশাসকের গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভের প্রচণ্ডতা আরও বাড়ে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্দোলন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬-দফা একটি অন্যতম মাইলফলক।

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ জুন এক অবিস্মরণীয় দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬-দফা আন্দোলন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন নতুন মাত্রা পায়। তিনি ঐতিহাসিক ৭ জুনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
কর্মসূচি : ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আওয়ামীলীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সূর্যোদয়ের সময়ে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন।

Monday, June 4, 2018

লোক সংগীতের কিংবদন্তী আব্দুল আলীম

লোক সংগীতের কিংবদন্তী আব্দুল আলীম

(জুলাই ২৭, ১৯৩১, তালিবপুর গ্রাম, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ - সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৭৪) বাংলা লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। আবদুল আলীমের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন; আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
বাবার নাম ছিল মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে গান গাইবার জন্য আগ্রহ জন্মে। ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গীত গুরু ছিলেন সৈয়দ গোলাম আলী। ঐ অল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো "তোর মোস্তফাকে দে না মাগো" এবং "আফতাব আলী বসলো পথে"। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত-কিংবদন্তি পুরুষ। Image may contain: 2 people, people smiling, closeup

সঙ্গীত শিক্ষা
পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় যান এবং সেখানে আব্বাসউদ্দিন ও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গান করেছেন। তিনি লোক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দীক্ষা নিয়েছেন বেদার উদ্দিন আহমেদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাই লাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। লেটো দলে, যাত্রা দলে কাজ করেছেন।

কর্মজীবন
Image may contain: 2 people, including Jahir Alim, people on stage
আব্দুল আলীমের বড় ছেলে কন্ঠশিল্পী জহির আলীম
দেশ বিভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তাঁর। আব্দুল আলীম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। কবি ও বাংলার লোক সঙ্গীতের গবেষক কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, "সমাজটকে যাঁরা জাগিয়েছেন আব্দুল আলীম তাঁদের একজন"।পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।

পুরস্কার ও সম্মাননা
আব্দুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন; এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।

Sunday, June 3, 2018

uttoron and the succession

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আধ্যাত্বিক বাউল কবি শিল্পী লালনের পদধূলিতে ধন্য আদি লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম পুন্যভুমি কুষ্টি্যা জেলার কৃতি সন্তান বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার মিল্টন খন্দকারের পরিবারের সন্তান টোকিও প্রবাসী কন্ঠশিল্পী রতন খন্দকারের সাথে হংকং এ একটি রেস্টুরেন্টে পরিচয় হয় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। রতন জাপানে লেখাপড়া করেছিল ৪ বছর। আবার জাপানে যাবে কারন সে ওখানে একজ€নের নিকট হৃদয়ের বন্ধনে প্রতিশ্রুত। 
ভাগ্য আমাদের দু'জনেরই ভালো ছিল বলতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক খালা যাকে গোপালগঞ্জের মানুষ লাভলু আপা হিসেবেই চিনতেন। তাঁর স্বামী মরহুম এস এ জালাল যিনি ১৯৭১ সালে টোকিও রেডিও তে বাংলা অনুষ্ঠানে খবর পড়তেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করতেন এবং তিনি জাপানী ভাষায় লেখা পড়া করেছিলেন বিধায় জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাষ্ট্রপ্রধানদের জাপান সরকারের সাথে সকল সভা সমিতির interpreter দ্বোভাষীর কাজটি করতেন। তিনি ছিলেন হংকংস্থ বাংলাদেশ কমিশনের কমিশনার । 
হংকং কমিশনে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে রতন খন্দকার ও আমার গান গাইবার সুযোগ হল এবং খুলে গেল রতন খন্দকার ও আমার জাপানে যাবার সোনালী দ্বার। 

ভিসা পেলাম। জাপান গেয়াম আমি ও রতন খন্দকার। রতন খন্দকার আগেও বলেছে" মুক্তিভাই, চলেন জাপান যাই, প্রাণ খুলে গান গাইবার এমন সুযোগ বিশ্বের কোথাও পাবেন না। আমাদের একটি সংগঠন আছে নাম "উত্তরণ"। দেখবেন ভালো থাকবেন। 

বাস! জাপান গেলাম। কেউ চিনেনা জানে না। কোথায় যাই কোথায় থাকি? কে দেবে চাকুরী আশ্রয়। না ভয় পাবার কোন কারন নেই। সেখানে রয়েছে দৌলত ভাই, নাট্যকার ঝুনা চৌধূরীর ছোট ভাই মান্না চৌধূরী শাহিন এবং সকলের শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াতঃ সঞ্জয় দাদা। আশ্রয় মিলে গেল। চাকুরী মিলে গেল সাথে বোনাস হিসেবে পেলাম এক ঝাঁক সাংস্কৃতিক কর্মী শিল্পী তবলা বাদক আরো অনেক কিছু। 

কেমনে ভুলি সে সোনালী দিনগুলো? কেমনে ভুলি সঞ্জয় দত্ত দাদাকে? কেমনে ভুলি রতন খন্দকার নাজিম উদ্দিন মান্না চৌধূরী। যেখানেই থাকি উত্তরন থাকে আমার অন্তরে। বড় মিস করি তোদের রতন মান্না নাজিম বাপ্পা শাহিন মনি । উত্তরণের উত্তরোত্তর আরো আরো ব্যাপক সাফল্য উন্নতি কামনা করছি। সবাই তোরা ভালো থাকিস তবে বাংলা মা"কে যেনো ভুলে না যাস।